শিশুদের মানসিক রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
শিশুদের মানসিক রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার প্রতিটি শিশু ভিন্ন, প্রতিটি মন ভিন্নরকম। কিন্তু যখন একটি শিশুর আচরণ হঠাৎ বদলে যায়, তখন আমাদের ভাবতে হয়, এর পেছনে কোনো মানসিক কারণ আছে কি না। ঢাকায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের জরিপ বলছে, ১৮ শতাংশেরও বেশি শিশু বিষণ্নতায় আক্রান্ত। এই সংখ্যা আমাদের বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ লেখায় আলোচনা করব শিশুদের মানসিক রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার নিয়ে। শিশুদের মধ্যে কেন মানসিক সমস্যা দেখা দেয়? শিশুদের মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়ার পেছনে নানা জৈবিক, পারিপার্শ্বিক ও পারিবারিক কারণ জড়িত থাকতে পারে। নিচে প্রধান কিছু কারণ তুলে ধরা হলো: জেনেটিক বা বংশগত প্রভাব: পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যদি মানসিক রোগের ইতিহাস থাকে, তবে শিশুর মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন—বাবা-মায়ের বিষণ্নতা বা উদ্বেগজনিত সমস্যা সন্তানের মধ্যেও দেখা দিতে পারে। পরিবেশগত সমস্যা: দমনমূলক, সহিংস বা মানসিক চাপযুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে আতঙ্ক, ভয় ও মানসিক অস্থিরতা জন্ম নিতে পারে। টক্সিক প্যারেন্টিং: অতিরিক্ত শাসন, অবহেলা, উপহাস, কিংবা শারীরিক-মানসিক নির্যাতন শিশুর আত্মবিশ্বাস ও মানসিক ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শারীরিক রোগ বা দুর্ঘটনা: দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা যেকোনো ট্রমা শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে, যা বিষণ্নতা বা উদ্বেগে রূপ নিতে পারে। ডিজিটাল আসক্তি ও একাকীত্ব: অতিরিক্ত সময় মোবাইল বা ট্যাবলেটে কাটানো, সামাজিক যোগাযোগের অভাব কিংবা বন্ধুর অভাব শিশুর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও ডিপ্রেশনের জন্ম দিতে পারে। রিহ্যাব সেবার জন্য ফ্রি কনসালটেশন নিতে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: কল করুন: +88 01716623665 শিশুদের সাধারণ মানসিক রোগ শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ধরন বিভিন্ন হতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ মানসিক রোগের তালিকা ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো: উদ্বেগ রোগ (Anxiety Disorders): শিশুরা অল্পতেই আতঙ্কিত হয়, সামাজিক পরিস্থিতিতে কথা বলতে ভয় পায়, কিংবা বারবার কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। মনোযোগ ঘাটতি ও হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD): মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, অতিরিক্ত চঞ্চলতা ও নিয়ন্ত্রণহীন আচরণ এই রোগের বৈশিষ্ট্য। খাওয়ার রোগ (Eating Disorders): অ্যানোরেক্সিয়া, বুলিমিয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়, যেখানে শিশুরা খাবার খেতে চায় না বা অতিরিক্ত খেয়ে ফেলে এবং পরে গিল্টিতে ভোগে। বিষণ্নতা (Depression): দীর্ঘদিন ধরে মন খারাপ থাকা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, ঘুম বা খাওয়ার অনিয়ম, আত্মঘাতী চিন্তা—এসব বিষণ্নতার লক্ষণ। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD): কোনো বড় দুর্ঘটনা বা মানসিক আঘাতের পরে শিশুরা দুঃস্বপ্ন, আতঙ্ক, অথবা আচরণগত পরিবর্তনের মধ্যে ভুগতে পারে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (ASD): সামাজিক যোগাযোগে সমস্যা, কথাবার্তায় অসামঞ্জস্য, এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ—এসব অটিজমের লক্ষণ। ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia): শিশুদের পড়াশোনায় সমস্যা হয়, বিশেষ করে পড়া, লেখা ও বানানে জটিলতা দেখা যায়। এটি কোনো বুদ্ধির ঘাটতি নয়, বরং একটি নিউরোডেভেলপমেন্টাল সমস্যা। শর্ট টার্ম মেমোরি লস: সাম্প্রতিক তথ্য মনে রাখতে না পারা, পড়া শিখে সাথে সাথে ভুলে যাওয়া ইত্যাদি মেমোরি ঘাটতির লক্ষণ। কনডাক্ট ডিজঅর্ডার ও ওডিডি (Oppositional Defiant Disorder): নিয়ম-নীতি মানতে না চাওয়া, বড়দের প্রতি বিরুদ্ধাচরণমূলক আচরণ, এবং আক্রমণাত্মক ব্যবহার এসব এই ডিসঅর্ডারের লক্ষণ। ক্লেপটোম্যানিয়া: অপ্রয়োজনীয় বা তুচ্ছ জিনিস চুরি করার প্রতি একধরনের মানসিক আসক্তি যা শিশুদের মধ্যে দেখা যেতে পারে। মানসিক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ শিশুদের মধ্যে মানসিক রোগ বা মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং কিছু লক্ষণ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এসব লক্ষণ যদি উপেক্ষা করা হয়, তবে পরবর্তীতে তা বড় ধরনের সমস্যায় রূপ নিতে পারে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক লক্ষণ তুলে ধরা হলো: দু’সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মন খারাপ থাকা: শিশুরা যদি দীর্ঘ সময় ধরে মনমরা, দুঃখিত বা বিরক্ত থাকে এবং সহজে আনন্দ অনুভব না করে, তাহলে তা বিষণ্নতার লক্ষণ হতে পারে। সামাজিকতা এড়িয়ে চলা: বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে না চাওয়া, পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলায় অনীহা—এগুলো সমাজবিমুখ আচরণের লক্ষণ, যা উদ্বেগ বা বিষণ্নতার নির্দেশক হতে পারে। আত্ম-ক্ষতি বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত: কখনো কখনো বড়দের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শিশুরা এমন কিছু মন্তব্য বা কাজ করতে পারে যা আত্ম-ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়। তবে এগুলোকে হালকাভাবে নেয়া উচিত নয়। এই ধরনের আচরণ মানসিক অসুস্থতার একটি গুরুতর ইঙ্গিত। আচরণগত পরিবর্তন: হঠাৎ করে অতিরিক্ত রাগান্বিত হয়ে ওঠা, আগের মতো কথা না বলা, অথবা নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করা মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। খাদ্যাভ্যাসের হঠাৎ পরিবর্তন: অস্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত খাওয়া বা একেবারেই না খাওয়া, খাবার নিয়ে অতিরিক্ত সচেতনতা কিংবা গোপনে খাওয়া-এইসব আচরণ খাওয়ার সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। ঘন ঘন মাথাব্যথা বা ঘুমের সমস্যা: মানসিক চাপ ও উদ্বেগ থেকে শিশুদের মাঝে ঘন ঘন মাথাব্যথা, পেটব্যথা কিংবা ঘুমের সমস্যা দেখা যেতে পারে। রাতের ঘুম না হওয়া কিংবা দুঃস্বপ্নে ভোগা মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। পড়াশোনায় মনোযোগহীনতা: আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও যদি শিশু পড়াশোনায় মন দিতে না পারে বা ফলাফল হঠাৎ খারাপ হতে শুরু করে, তবে তা মানসিক অস্থিরতা, উদ্বেগ বা ADHD-এর উপসর্গ হতে পারে। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে পিতা-মাতার উচিত দেরি না করে একজন শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া। শিশুর খারাপ আচরণ মানেই কি মানসিক সমস্যা? শিশুরা বেড়ে ওঠার সময় নানা ধরনের আচরণ করে থাকে, যা সবসময় মানসিক রোগের লক্ষণ নয়। তবে কিছু আচরণ নিয়মিত বা তীব্র হলে তা উদ্বেগের বিষয় হতে পারে। স্বাভাবিক আচরণগত পর্যায়: শিশুদের বয়সভেদে আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হওয়া বা অভিমান করা স্বাভাবিক। যেমন ২-৪ বছর বয়সে “ট্যানট্রাম” বা মাটি লুটিয়ে কাঁদা এক ধরনের প্রাকৃতিক আচরণ। মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা: অনেক সময় শিশু খারাপ আচরণ করে পিতা-মাতার মনোযোগ পেতে চায়, বিশেষ করে যদি তারা অনুভব করে যে তাদের চাহিদা বা অনুভূতিগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে না। শিক্ষার অভাব বা পরিবেশগত প্রভাব: শিশু যদি এমন পরিবেশে থাকে যেখানে নিয়ম-শৃঙ্খলার ঘাটতি আছে, কিংবা সহিংসতা দেখতে পায়, তাহলে তার আচরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, যা মানসিক রোগ নয়। তবে যদি নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়, তাহলে তা মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে: আচরণ নিয়মিত ও বেগতিক হয়ে ওঠা অন্য শিশুদের বা নিজেকে ক্ষতি করা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানতে চরম অনীহা সমাজ বা পরিবারের প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব এমন পরিস্থিতিতে পেশাদার কাউন্সেলিং বা থেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। মনে রাখতে হবে, সব শিশুই আলাদা। তাই তাদের আচরণ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি সবচেয়ে কার্যকর। শিশুদের মানসিক রোগের চিকিৎসা ও প্রতিকার: কীভাবে সাহায্য করা যায়? শিশুর মানসিক সমস্যার লক্ষণ চিহ্নিত করার পর যত দ্রুত সম্ভব সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। একটি পরিপূর্ণ সহায়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে শিশুর মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা যায়। নিচে কিছু কার্যকর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো: মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন শিশুর আচরণে যদি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেন—যেমন অতিরিক্ত রাগ, বিষণ্নতা, বা একাকীত্ব—তাহলে প্রথমেই একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। তারা সঠিক মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বা থেরাপি নির্ধারণ করতে পারবেন। থেরাপি বা কাউন্সেলিং করান সাইকোথেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT), আর্ট থেরাপি বা প্লে থেরাপির মাধ্যমে শিশুর মানসিক চাপ, ভয় বা ট্রমা নিরসন সম্ভব। একজন প্রশিক্ষিত চাইল্ড সাইকোলোজিস্ট এই সেশনগুলো পরিচালনা করে শিশুদের অনুভূতি প্রকাশ
