মাদকাসক্তির কারণ ও প্রতিকার
মাদকাসক্তি বর্তমান সমাজের একটি ভয়াবহ সমস্যা। এটি শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো পরিবার ও সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মাদকাসক্তির কারণ ও প্রতিকার উপায় নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন, যেন সচেতনতা বৃদ্ধি পায় ও সমাধানের পথ খোঁজা যায়। মাদকাসক্তি কি? মাদকাসক্তি হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি নিয়মিতভাবে মাদক গ্রহণ করতে থাকে এবং সে তা ছাড়া থাকতে পারে না। এটি মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্ভরশীলতার সৃষ্টি করে। মাদকসেবীর চিন্তা-চেতনা, আচরণ, এবং দৈনন্দিন জীবন বিকৃত হয়ে পড়ে। মাদকের প্রতি আসক্তির রকমভেদ শারীরিক আসক্তি মানসিক আসক্তি সামাজিক নির্ভরতা রিহ্যাব সেবার জন্য ফ্রি কনসালটেশন নিতে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: কল করুন: +88 01716623665 মাদকাসক্তির কারণ মাদকাসক্তি একটি জটিল এবং বহুস্তরবিশিষ্ট সমস্যা। এটি কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে ঘটে না, বরং মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক নানা প্রভাব এতে কাজ করে। চলুন, নিচে প্রতিটি কারণ আলাদা করে বিস্তারিতভাবে জানি। মানসিক চাপ মানসিক চাপ হচ্ছে এমন একটি চাপ যেখানে মানুষ নিজেকে খুব বেশি একা, হীনমন্য অথবা হতাশ বোধ করে। এই অবস্থায় অনেকে মাদকের আশ্রয় নেয়, কারণ তারা তাৎক্ষণিকভাবে সুখ বা স্বস্তি খোঁজে। পড়ালেখা, চাকরি বা ব্যবসায় ব্যর্থতা পারিবারিক কলহ বা সম্পর্ক ভাঙন জীবনের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলা সামাজিক ব্যর্থতা এগুলো মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। অনেকেই মনে করে, মাদক গ্রহণ করলে চাপ কমে যাবে। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। সাময়িক আরাম হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনে। কৌতূহল ও বন্ধুদের প্ররোচনা তরুণদের মধ্যে কৌতূহল খুব স্বাভাবিক। নতুন কিছু জানার বা অভিজ্ঞতা নেয়ার আগ্রহ থেকেই অনেকেই প্রথম মাদক গ্রহণ করে। বন্ধুরা বলল, “টেনশন যাবে” কেউ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল ভিডিও বা সিনেমায় দেখল, নায়ক নেশা করছে “একবার করলে কীইবা হবে!” এইরকম ভাবনা থেকেই শুরু হয় প্রথম ধাপ। কিন্তু এই ‘একবার’ই অনেক সময় জীবনের ভয়ঙ্কর মোড় হয়ে দাঁড়ায়। পারিবারিক সমস্যা একটি অশান্ত পারিবারিক পরিবেশ একজন শিশুর বা কিশোরের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। মা-বাবার অবহেলা, ডিভোর্স, দারিদ্র্য অথবা পারিবারিক সহিংসতা তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। বাবা-মায়ের ঝগড়া মা-বাবার প্রতি সন্তানের আস্থা কমে যাওয়া পরিবারের অন্য সদস্যের মাদক ব্যবহার এই পরিস্থিতিতে ছেলে-মেয়েরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং বাইরে ‘অভিভাবক খোঁজে’, যা অনেক সময় মাদকের পথ দেখায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মাদকসেবন: ভার্চুয়াল জগতের বাস্তব বিপদ বর্তমানে ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউবে অনেক ভিডিও ও কনটেন্টে মাদককে গ্ল্যামারাইজ করে দেখানো হয়। বিশেষ করে তারকা বা ইনফ্লুয়েন্সাররা কখনও ইচ্ছায়, কখনও অনিচ্ছায় মাদকের ব্যবহার বা প্রচার করে থাকেন। “স্টাইলিশ” সিগারেট বা গাঁজা ভিডিও “হ্যাশট্যাগ ৪২০” ট্রেন্ড বন্ধুরা এসব কনটেন্ট শেয়ার করে উৎসাহিত করা এসব মিলিয়ে একটি তরুণ মনে করে, নেশা করা কোনো খারাপ কাজ না, বরং কুল বা মজার কিছু। কিন্তু বাস্তবতা তার উল্টো। পৃথিবীব্যাপী মাদকের বিস্তার: একটি গ্লোবাল ব্যাধি মাদক কেবল কোনো দেশের সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক মহামারী। উন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এর সহজলভ্যতা ও অবাধ বিস্তার লক্ষণীয়। সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে মাদক প্রবেশ সন্ত্রাসবাদ ও মানবপাচারের সঙ্গে মাদকের গভীর সম্পর্ক বড় বড় মাফিয়া গোষ্ঠীর মাধ্যমে মাদক ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে। শিশু ও মাদকাসক্তি ছোটদের মধ্যেও নেশার প্রভাব আজকাল মাদকের ছোবল থেকে শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। বাবা-মায়ের অভাব-অভিযোগ, পথশিশুদের অবহেলা বা বড়দের উদাহরণ দেখে অনেক শিশু মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পরিবারে কেউ নেশাগ্রস্ত হলে, শিশুরাও উৎসাহী হয় রাস্তার শিশুরা সস্তা নেশাদ্রব্য (গ্লু, কফ সিরাপ) ব্যবহার করে অনেক অপরাধী চক্র শিশুদের দিয়ে মাদক পাচার করায় প্রতিরোধে করণীয় শিশুদের সাথে সময় কাটান তাদের মানসিক অবস্থার খোঁজ রাখুন স্কুল পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করুন মাদক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করুন বয়স ও মাদকাসক্তির সম্পর্ক: বয়সভেদে ভিন্ন প্রভাব মাদক গ্রহণের প্রবণতা বয়সের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয়। নিচে বিভিন্ন বয়সে মাদকগ্রহণের কারণগুলো তুলে ধরা হলো। কিশোর (১৩-১৮ বছর) কৌতূহল বন্ধুদের সাথে মানিয়ে চলা প্রমাণ করার প্রবণতা (আমি ভয় পাই না) তরুণ (১৮-৩০ বছর) পড়াশোনার চাপ প্রেমে ব্যর্থতা একাকীত্ব ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা বয়স্ক (৩০ ঊর্ধ্ব) সংসার ও চাকরির চাপ সম্পর্কের টানাপোড়েন অবসাদ, নিঃসঙ্গতা, শারীরিক ব্যথা সবার ক্ষেত্রেই মাদক একটি মিথ্যা আশ্বাস দেয় আরাম বা মুক্তির। অথচ বাস্তবে তা তাদের আরও বেশি অসহায় করে তোলে। মাদক গ্রহনে ক্ষতি শারীরিক ক্ষতি লিভার ও কিডনির ক্ষতি রক্তচাপ বৃদ্ধি হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট মানসিক ক্ষতি স্মৃতিভ্রংশ অবসাদ মনোবিকৃতি মাদকাসক্তি জনিত ক্ষতি মাদক শুধু একজন ব্যক্তির নয়, পুরো পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এটি বহুমাত্রিক ক্ষতির কারণ হয়। নিচে তিনটি প্রধান দিক থেকে এই ক্ষতির বর্ণনা দেওয়া হলো। পারিবারিক ক্ষতি পরিবারে অশান্তি মাদকাসক্ত ব্যক্তি পরিবারে অস্থিরতা তৈরি করে। কথায় কথায় রাগ, চিৎকার, সহিংসতা ও অপমানের ঘটনা ঘটে। এতে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়। সন্তানদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস যদি বাবা-মা অথবা বড় ভাইবোন মাদকাসক্ত হন, তবে শিশুরা একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বড় হয়। তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নিজেরাও আসক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। সামাজিক ক্ষতি চুরি, ডাকাতি, খুনসহ অপরাধ প্রবণতা মাদকের খরচ চালাতে গিয়ে অনেকেই চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি বা খুনের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এতে সমাজে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি যখন সমাজের যুবসমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, তখন শিক্ষার হার কমে, কর্মক্ষমতা নষ্ট হয় এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ে। অর্থনৈতিক ক্ষতি চাকরি হারানো মাদকাসক্ত ব্যক্তি সময়মতো অফিস করতে পারে না, কাজে মনোযোগ দেয় না। ফলে সে ধীরে ধীরে চাকরি হারিয়ে ফেলে। অর্থ অপচয় মাদক কেনার পেছনে সব অর্থ ব্যয় হয়। অনেক সময় পরিবারের জমানো অর্থ, গয়না বা সম্পত্তিও বিক্রি করে ফেলা হয় মাদকের জন্য। মাদকাসক্তের চিকিৎসা মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির জন্য চিকিৎসা একটি দীর্ঘমেয়াদী ও ধৈর্যপূর্ণ প্রক্রিয়া। এটি সাধারণত চারটি ধাপে সম্পন্ন হয়। কাউন্সেলিং একজন অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা থেরাপিস্ট মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে মানসিকভাবে সচেতন করে তোলেন। তাকে বোঝানো হয় জীবনের মূল্য, পরিবারে তার ভূমিকা ও ব্যক্তিত্ব। কাজের ধরণ: ইতিবাচক চিন্তার অনুশীলন আত্নমর্যাদা উন্নয়ন মানসিক জোর বাড়ানো চিকিৎসা ও ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয় যা ধীরে ধীরে আসক্তি কমাতে সাহায্য করে। কিছু ওষুধের মাধ্যমে withdrawal বা উপসর্গগুলোর নিয়ন্ত্রণও সম্ভব। চিকিৎসার লক্ষ্য: মাদক ছাড়ার উপসর্গ (withdrawal) নিয়ন্ত্রণ রিল্যাপ্স প্রতিরোধ মস্তিষ্কের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা পুনর্বাসন কেন্দ্র (Rehabilitation Center) রিহ্যাব সেন্টারে রোগীকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, মেডিটেশন ও গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে রাখা হয়। এখানে একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ জীবনে ফিরে যায়। সুবিধা: নিয়মিত মনিটরিং গ্রুপ থেরাপি ও যোগব্যায়াম পুনরায় সমাজে একীভূত হওয়ার প্রস্তুতি পারিবারিক সহায়তা রোগীর আরোগ্য হওয়ার পেছনে পরিবারের ভালোবাসা ও মানসিক সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক রোগী শুধু পরিবার থেকে সাহস পেয়ে মাদক ছেড়ে দিতে পেরেছেন। সহযোগিতার ধরন: গঠনমূলক কথোপকথন বোঝাপড়া এবং ধৈর্য চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ মাদকাসক্তি প্রতিকারের উপায় মাদকাসক্তি রোধ করতে হলে প্রতিটি স্তরে (ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র) সচেতনতা
