আসক্তির আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি
Blog

আসক্তির আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি

আসক্তি একটি জটিল মানসিক ও শারীরিক সমস্যা, যা ব্যক্তির জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তবে সঠিক চিকিৎসা ও সহায়তায় এটি নিরাময়যোগ্য। আসক্তির আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আসক্তি কি? আসক্তি হলো এমন একটি মানসিক ও শারীরিক অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো পদার্থ বা আচরণের প্রতি অতিরিক্তভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই নির্ভরশীলতা এতটাই তীব্র হয় যে, ব্যক্তির জীবনযাপন, মানসিক স্থিতি এবং সম্পর্কসহ সবকিছুতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। রিহ্যাব সেবার জন্য ফ্রি কনসালটেশন নিতে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: কল করুন: +88 01716623665 আসক্তির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অভ্যাস বা ব্যবহার বন্ধ করতে না পারা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা ক্ষতিকর পরিণতি জানা সত্ত্বেও অভ্যাস চালিয়ে যাওয়া দৈনন্দিন জীবন ও দায়িত্ব পালনে ব্যাঘাত ঘটানো আসক্তির কারণ আসক্তি সাধারণত মস্তিষ্কের “পুরস্কার ব্যবস্থা” বিকৃত হয়ে যাওয়ার ফল। বারবার কোনো বস্তু বা আচরণ গ্রহণের মাধ্যমে ডোপামিন নামক আনন্দদায়ক রাসায়নিক নিঃসরণ হয়, যা ব্যক্তিকে আবারও সেই অভ্যাসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে জিনগত প্রবণতা, পারিবারিক পরিবেশ বা মানসিক চাপও আসক্তির পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। আসক্তির বিভিন্ন ধরণ আসক্তি শুধু মাদক বা অ্যালকোহলেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিভিন্ন রকম হতে পারে এবং প্রতিটিই ভিন্নভাবে ক্ষতিকর। মাদকাসক্তি এটি এমন এক অবস্থা যেখানে ব্যক্তি হেরোইন, ইয়াবা, গাঁজা, কোকেইন ইত্যাদি নেশাজাতীয় পদার্থ গ্রহণের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এটি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। অ্যালকোহল আসক্তি অ্যালকোহলের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এটি যকৃত, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কের উপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। নিয়ন্ত্রণহীন খাওয়া এটি এমন একটি আসক্তি, যেখানে ব্যক্তি একসাথে অপ্রয়োজনীয়ভাবে অনেক খাবার খেয়ে ফেলে এবং পরে অপরাধবোধে ভোগে। এটি দেহের ওজন ও আত্মমর্যাদার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জুয়া খেলা জুয়া খেলার প্রতি আসক্তি ব্যক্তিকে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে। এতে পরিবারের শান্তি নষ্ট হয় এবং ব্যক্তি মানসিক চাপ ও হতাশায় ভোগে। ইন্টারনেট বা গেমিং আসক্তি ডিজিটাল যুগে এটি সবচেয়ে প্রচলিত আসক্তির একটি। দীর্ঘক্ষণ গেম খেলা, সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করা বা অনলাইনে সময় কাটানো ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। আসক্তির লক্ষণ নিচের লক্ষণগুলো কারো মধ্যে দেখা গেলে তাকে আসক্ত বলে বিবেচনা করা যেতে পারে: নির্দিষ্ট কাজ বা বস্তু ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে না পারা নিজের চেষ্টা সত্ত্বেও অভ্যাস বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়া কাজ, পরিবার, সমাজকে অবহেলা করা শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও অভ্যাস চালিয়ে যাওয়া ব্যবহার বা অভ্যাস গোপন রাখা আসক্তির প্রভাব আসক্তি একজন ব্যক্তির পাশাপাশি তার পরিবার, সমাজ এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উপর গভীর প্রভাব ফেলে। শারীরিক প্রভাব: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয় দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতা তৈরি হয় মানসিক প্রভাব: হতাশা ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পায় আত্মবিশ্বাস কমে যায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস পায় সামাজিক প্রভাব: সম্পর্ক নষ্ট হয় পারিবারিক কলহ বেড়ে যায় কর্মজীবন ব্যাহত হয় সমাজে একঘরে হয়ে পড়া আর্থিক প্রভাব: অর্থের অপচয় ঋণগ্রস্ত হওয়া চুরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়া আসক্তির চিকিৎসা পদ্ধতি আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। আসুন ধাপে ধাপে জেনে নিই আসক্তির চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো। ডিটক্সিফিকেশন (Detoxification) ডিটক্সিফিকেশন আসক্তি চিকিৎসার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই প্রক্রিয়ায় শরীর থেকে মাদকের বা নেশাজাতীয় পদার্থের বিষাক্ত উপাদানগুলো ধীরে ধীরে দূর করা হয়। মাদক সেবনের কারণে শরীরে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কমানোর জন্য এই ধাপ অপরিহার্য। কেন দরকার? আসক্ত ব্যক্তি মাদক সেবন বন্ধ করলে শরীরে নানা রকম শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ দেখা দেয়, যা উইথড্রয়াল সিন্ড্রোম নামে পরিচিত। এর মধ্যে থাকতে পারে মাথা ঘোরা, অবসাদ, পেশীতে ব্যথা, ঘাম পড়া, এবং মানসিক চাপ। কিভাবে করা হয়? চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে ওষুধ প্রয়োগ করে শরীর থেকে মাদকের প্রভাব দূর করা হয়। এতে উইথড্রয়াল উপসর্গ কমে এবং শরীর সুস্থ হতে শুরু করে। কত সময় লাগে? সাধারণত ডিটক্সিফিকেশন ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে সম্পন্ন হয়, তবে আসক্তির প্রকৃতি ও মাত্রা অনুসারে সময় পরিবর্তিত হতে পারে। থেরাপি (Therapy) ডিটক্সিফিকেশনের পর আসক্তির মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো নির্ণয় ও সমাধানে বিভিন্ন থেরাপি ব্যবহার করা হয়। থেরাপি আসক্তির পুনরায় সেবন রোধে এবং মানসিক সুস্থতা অর্জনে সহায়ক। কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT) CBT হল একটি কার্যকর থেরাপি যা নেতিবাচক চিন্তা ও আচরণ চিহ্নিত করে এবং তা পরিবর্তনে সাহায্য করে। আসক্ত ব্যক্তি মাদক সেবনের পিছনে যে ভুল বিশ্বাস বা অস্থিরতা কাজ করে, তা কাটিয়ে উঠতে CBT সহায়তা করে। কাজের ধরন: থেরাপিস্ট রোগীর সাথে আলোচনা করে তার চিন্তা ও অনুভূতির কারণ খুঁজে বের করেন। পরে ধাপে ধাপে নতুন ও ইতিবাচক চিন্তার পথ দেখানো হয়। মোটিভেশনাল এনহ্যান্সমেন্ট থেরাপি (MET) MET থেরাপি রোগীর মধ্যে চিকিৎসা গ্রহণের আগ্রহ ও প্রেরণা বাড়ায়। অনেক সময় আসক্ত ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারেন না যে তার জীবনে সমস্যা হচ্ছে। এই থেরাপি তাদের সচেতন করে এবং চিকিৎসার জন্য মানসিক প্রস্তুতি দেয়। চিকিৎসা সহায়ক ওষুধ (Medication-Assisted Treatment) আসক্তি নিরাময়ে কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যা মাদকগ্রস্থ ব্যক্তির আকর্ষণ কমায় এবং মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে। কেন প্রয়োজন? মাদক সেবনের অভ্যাস ছেড়ে দেওয়া খুব কঠিন। ওষুধের মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষা বা ক্রেভিং কমানো যায়, যা পুনরায় আসক্তির ঝুঁকি কমায়। কোন ধরনের ওষুধ? ভ্যারিয়াস ধরনের ওষুধ আছে, যেমন মেথাডোন, বুপ্রেনরফিন, এবং নালট্রেক্সোন, যেগুলো আসক্তির ধরন অনুসারে ব্যবহৃত হয়। গ্রুপ থেরাপি ও সাপোর্ট গ্রুপ (Group Therapy & Support Groups) একই ধরনের সমস্যায় ভুগছেন এমন মানুষের সমবায় উদ্যোগ গ্রুপ থেরাপি। এখানে আসক্তরা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন এবং একে অপরকে মানসিক ও সামাজিক সহায়তা দেন। কেন দরকার? ব্যক্তিগত থেরাপির পাশাপাশি, গ্রুপ থেরাপি আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং সমাজের অংশ হয়ে ওঠার শক্তি দেয়। কিভাবে কাজ করে? নিয়মিত মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করে সদস্যরা নিজেদের সমস্যার কথা বলেন, অন্যদের গল্প শুনেন, এবং পরস্পরের প্রতি উৎসাহ ও সাহায্যের হাত বাড়ান। ইনপেশেন্ট এবং আউটপেশেন্ট রিহ্যাব (Inpatient & Outpatient Rehab) রিহ্যাব প্রোগ্রাম আসক্তি থেকে মুক্তির জন্য দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্ল্যাটফর্ম। ইনপেশেন্ট রিহ্যাব রোগী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হাসপাতাল বা রিহ্যাব সেন্টারে অবস্থান করেন। ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকেন। নিয়মিত থেরাপি, মেডিকেশন, ও অন্যান্য সহায়ক সেবা পাওয়া যায়। এটি গুরুতর আসক্তির জন্য বেশি কার্যকর। আউটপেশেন্ট রিহ্যাব রোগী বাড়ি থেকে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। নির্ধারিত সময়ে ক্লিনিক বা সেন্টারে এসে থেরাপি ও পরামর্শ নেন। কাজকর্মের পাশাপাশি চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। হালকা থেকে মাঝারি আসক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। লাইফস্টাইল পরিবর্তন: আসক্তির চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ওষুধ বা থেরাপি নয়, জীবনযাত্রার পরিবর্তনও অত্যন্ত জরুরি। সঠিক জীবনধারা আসক্তি নিরাময় প্রক্রিয়াকে মজবুত করে এবং সুস্থ মন ও শরীর বজায় রাখতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত ঘুম মানুষের মস্তিষ্ক এবং শরীর ঠিকমতো কাজ করার জন্য নিয়মিত ঘুম অপরিহার্য। আসক্তির চিকিৎসায় পর্যাপ্ত ঘুম মস্তিষ্কের পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে এবং মানসিক চাপ